অর্থনীতি - কেন পড়ব?

Image by Melissa Ling © The Balance 2019 

কোনো বিষয়ে পড়ার জন্য আমরা যখন আগ্রহ প্রকাশ করি, আমরা বলি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, ব্যাংকিং পড়ে ব্যাংকার কিংবা সাংবাদিকতা পড়ে সাংবাদিক হতে চাই তাহলে কি অর্থনীতি পড়ে অর্থনীতিবিদ হবো? মজাটা এখানেই অর্থনীতি পড়ে তুমি যেকোনো পর্যায়ে যেতে পারবে বিষয়টা ডাক্তারি পড়ে বিসিএস (পুলিশ ক্যাডার) এ যাওয়ার মতো না সত্যিকার অর্থেই অর্থনীতি পড়ে অর্জিত জ্ঞান যেকোনো ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারো হতে পারো তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হতে পারো গবেষক, হতে পারো বহুজাতিক কোম্পানির ডিরেক্টর, হতে পারো আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, হতে পারো সমাজকর্মী, কিংবা হয়ে যেতে পারো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর! 

আসলে অর্থনীতি অনেক প্রসারিত একটি বিষয় খেয়াল করলেই দেখবে স্টক মার্কেট থেকে শুরু করে বাড়ির পাশে ছোট বাজার কিংবা জাতীয় বাজেট থেকে শুরু করে ঘরের আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি আমরা সবাই প্রতিদিনই অসংখ্য অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিই, পার্থক্য শুধু আমরা জানিই না সেগুলো যে অর্থনীতির পাঠ্য

তাহলে অর্থনীতিটা আসলে কী? অর্থনীতি হচ্ছে খুবই জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় এটা প্রধানত সাহায্য করে সিদ্ধান্ত নিতে অর্থনীতির মূল ধারণা হচ্ছে কীভাবে আমাদের কোনোকিছু পাওয়ার যে অসীম চাহিদা বা অপরিসীম অভাববোধ সেটাকে সীমিত সম্পদ দিয়ে কীভাবে পূরণ করা যায় এই সম্পদ হতে পারে টাকা পয়সা, হতে পারে যেকোনো বস্তু বা দ্রব্য কিংবা সময় এই স্বল্পপরিমাণ সম্পদ দিয়ে কীভাবে আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সবচেয়ে এফিশিয়েন্টলি পূরণ করা যায় তাই শেখানো হয় এখানে সেজন্য আছে বিভিন্ন চমকপ্রদ থিওরি, আছে অনেক গাণিতিক সূত্র, আছে অসংখ্য ডেফিনিশন কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এই ক্ষেত্রে তুমি নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে পারো হয়তো এই যে সম্পদকে ইফেক্টিভলি ব্যবহার করা, তা নিয়ে তোমার মাথায় অভিনব আইডিয়া কিলবিল করছে অর্থনীতির জ্ঞান থাকলে সহজেই এই আইডিয়াটা কতটুকু কার্যকর তা বের করে ফেলতে পারো আর যদি সেই আইডিয়া হয় পৃথিবীকে বদলে দেবার মতো, তাহলে কে জানে অর্থনীতিতে নোবেলটাও তোমার হতে পারে!

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি সামাজিক বিজ্ঞানের একটা স্ট্রিম, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এটা মানবিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত অথচ এটিই মনে হয় একমাত্র বিষয় যেখানে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা আর মানবিকের একটা অপূর্ব মেলবন্ধন পাওয়া যায় একদিকে তুমি জানবে গণিত, একদিকে শিখবে বিজনেস স্ট্র্যাটেজি আবার অন্যদিকে পড়বে দেশ ও বিশ্বের রাজনীতি, সমাজ আর ইতিহাস নিয়ে অর্থনীতির মতো এত বহুমুখী ভার্সেটাইল বিষয় দুটি নেই

কোথায় কোথায় পড়ানো হয়?

বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিগুলো বাদে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই (সরকারি ও বেসরকারি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগ হিসেবে অর্থনীতি আছে। সাধারণত অনার্সের মেয়াদ ৪ বছর ও মাস্টার্সের মেয়াদ এক বছর ডিগ্রী কলেজগুলোতেও ইকনোমিক্স বেশ কমন বিষয়

একাডেমিক কোর্সঃ

অনার্সঃ

·        মাইক্রো ইকোনোমিকস

·        ম্যাক্রো ইকোনোমিকস

·        গণিত

·        পরিসংখ্যান

·        ইকোনোমেট্রিকস

·        হেলথ ইকোনোমিকস

·        পাবলিক ইকোনোমিকস

·        ফিন্যান্স

·        একাউন্টিং

·        দর্শন

·        কম্পিউটার ও সফটওয়্যার এনালাইসিস

·        ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকস

·        রিসার্চ মেথডোলজি

·        এনভায়রনমেন্টাল ইকোনোমিকস

·        বাংলাদেশের অর্থনীতি

·        রাষ্ট্রবিজ্ঞান

 

মাস্টার্সঃ

·        মাইক্রো ও ম্যাক্রো ইকোনোমিকস

·        ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড

·        বাংলাদেশের অর্থনীতিঃ সেক্টোরাল স্টাডিজ

·        ইকোনোমিক মডেলিং

·        প্যানেল ডাটা অ্যান্ড নন লিনিয়ার ইকোনোমেট্রিকস

·        ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনোমিকস

 

জব মার্কেটঃ

শুরুতেই বলেছি অর্থনীতি পড়ে কাজ করার সুযোগ বহুমুখী ইকনোমিক্স যেহেতু রিসার্চ ওরিয়েন্টেড সাবজেক্ট, তাই পাশ করার পর সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকে রিসার্চ অর্গানাইজেশানে। সিপিডি, বিআইডিএস, সানেম ইত্যাদি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর তরুণ মেধাবী অর্থনীতিবিদগণ তাদের ক্যারিয়ার শুরু করার সুযোগ পান। এরপর আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক এর পোস্ট। সাধারণ পদগুলোর পাশাপাশি শুধু স্ট্যাটিস্টিক্স আর ইকনোমিক্সের জন্য ডেডিকেটেড কিছু পোস্ট থাকে। এর বাইরে থাকে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংক, কন্সাল্টেন্সি ফার্ম, এনজিও, কলেজের প্রভাষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সুযোগ।

এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএমএফ ইত্যাদি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে চাকরির সুযোগ আর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফিন্যান্স এডভাইজার সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট তো রয়েছেই

স্যালারিঃ

সম্মানীটা একেক ক্ষেত্রে একেকরকমযেমন বিআইডিএস, সানেম বা সিপিডির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে স্যালারি শুরুতে ২৫-৩৫ হাজারের মাঝে থাকে। অভিজ্ঞতা থাকা সাপেক্ষে স্যালারির এমাউন্ট বাড়ে। আবার আইএফপিআরআই-তে সুযোগ এগুলোর তুলনায় বেশ ভালো। তাদের স্টার্টিং স্যালারি প্রায় ৭০ হাজার

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্যালারি ফার্স্ট ক্লাস গ্যাজেটেড অফিসারদের স্কেলে শুরু হয়, ২২ হাজার টাকা বেসিক+এডিশনাল বেনেফিটস। জেনারেল অফিসার (এটা প্রধানত সেকেন্ড ক্লাস পোস্ট) এর স্যালারি স্কেল মোটামুটি ১৮ হাজার থেকে শুরু, এই পোস্টে জয়েন করলে দুইবছর চাকরি করার পরে প্রোমোশান দিয়ে এডিশনাল ডিরেক্টর পোস্টে দেয়, তখন থেকে ফার্স্ট ক্লাস গ্যাজেটেড পোস্টের স্যালারি অনুযায়ী এগুতে থাকে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর স্যালারি ৩০-৩৫ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হয়। ব্যতিক্রম আছে, যেমন ব্র‍্যাক ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক। এদের স্যালারি ৬০ হাজারের উপর। এক বছর ট্রেইনি পিরিয়ড পার হবার পর স্যালারি সিগনিফিকেন্টলি বেড়ে যায়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এবং কলেজগুলোর প্রভাষকের স্যালারি অনেকটা রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলোর মতই। ৩০ হাজার থেকে সচরাচর শুরু হয়, কিন্তু যদি নর্থ অ্যামেরিকান একটা ডিগ্রী থাকলে শুরুতেই প্রভাষকের জায়গায় এসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসাবে শুরু করা যায়। এটা অলিখিত নিয়ম।

এনজিও বা কন্সাল্টেন্সি ফার্মগুলোর স্যালারি তুলনামূলক কম। বৃহৎ পরিসরের এনজিওগুলোতে যেমন ব্র‍্যাক এ স্যালারি সচরাচর ৩০ হাজার দিয়ে শুরু করে কিন্তু এক্সপেরিয়েন্স বা সিভিতে রিলেভেন্ট এক্সট্রা কারিকুলার্স থাকা সাপেক্ষে স্যালারি বাড়ে। এর বাইরে থাকা, খাওয়া, যাতায়াত সুবিধা ইত্যাদি বিভিন্ন বেনেফিটস পাওয়া যায়

উচ্চশিক্ষার সুযোগঃ

অন্য মেজর এর তুলনায় অনার্স মাস্টার্স দুইটাতেই ইকোনোমিকসের স্কলারশিপ অপরচুনিটি বেশি। বিশেষত কানাডা বা নর্থ অ্যামেরিকার দিকে এশিয়া থেকে প্রতিবছর প্রচুর ছাত্রছাত্রী পড়তে যায়। তুলনামূলক কঠিন কারিকুলাম হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু এশিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা পড়ায়, তাই এখান থেকে যাওয়া স্টুডেন্টরা ভালো করে আসছে গত ২০-২৫ বছর ধরে এজন্যে এই সুযোগগুলো বাংলাদেশ থেকে বেশ ভালোভাবে পাওয়া যায়

স্কলারশিপ বা ওয়েইভার পাওয়া যায় সাধারণত সিজিপিএ আর SAT/GRE/IELTS এর স্কোর এর উপর ভিত্তি করে। সচরাচর ওয়েভারে যায় বেশির ভাগ মানুষ। এমাউন্টটা স্কোর অনুযায়ী ভ্যারি করে ফুল ফ্রি স্কলারশিপ অপরচুনিটিও আছে, তবে তুলনামূলকভাবে একটু কম।

আগ্রহ নিয়ে অর্থনীতি পড়লে অনেক বড় বড় সুযোগ তোমার দরজায় কড়া নাড়তে পারে শুধু প্যাশন থাকতে হবে, ভালো করার ইচ্ছা থাকতে হবে পুঁথিগত পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে সবরকম অভিজ্ঞতা অর্জনের মানসিকতা থাকতে হবে পড়াশোনার চাপ থাকবেই, কিন্তু তাতে দমে গেলে চলবে না চোখ কান খোলা রাখতে হবে লক্ষ্য স্থির রেখে প্রস্তুতি নিতে হবে শুরু থেকেই অর্থনীতি বিশাল এক সম্ভাবনার নাম, তাদের জন্য, যারা এতে নিজের শ্রম, মেধা, যোগ্যতা ও অর্জন বিনিয়োগ করতে রাজি 

 

তথ্য সহায়তায়ঃ

সায়ন্তন মিশকাত জামি

এমএসএস (১ম সেমিস্টার)

অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

তাহমিদ জামান খান

বিএসএস (২য় বর্ষ)

অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


লিখেছেনঃ

রিফাহ তাসনিয়া পূর্বিতা

বিএসএস (১ম বর্ষ)

অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়




Comments